চট্টগ্রাম, ১১ মে : আজ মহান বুদ্ধ পূর্ণিমা- ২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ। বুদ্ধ পূর্ণিমা বিশ্বে বৌদ্ধদের প্রধানতম ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব। আজ থেকে ২৬৪৯ বছর পূর্বে এদিনে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক মহামানব গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে (বর্তমান নেপাল) রাজা শুদ্ধোদন ও রাণী মহামায়ার দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তাদের কোল আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন এক পারমীবান সত্ত্ব, নাম রাখা হয় সিদ্ধার্থ। উনত্রিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে ছয় বছর কঠোর সাধনা বলে পয়ঁত্রিশ বছর বয়সে ২৬১৪ বছর পূর্বে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথির এইদিনে গয়ার বোধিদ্রুমমূলে বসে সর্বজ্ঞতা তথা বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর তাঁর নবলব্দ জ্ঞান প্রচার করে ২৫৬৯ বছর পূর্বে কুশিনগরে মহাপরিনির্বাণ লাভ অর্থাৎ দেহত্যাগ করেন, সেদিনও ছিল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। তাই ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত এই দিনটি বৌদ্ধদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্রতম দিন।
বিশ্বের আলো খ্যাত মহামানব তথাগত গৌতম বুদ্ধ বিশ্বশান্তির নন্দিত প্রতীক হিসাবে বিবেচিত। ১৯৯৯ সালে বিশ্বের মিলনসভা খ্যাত জাতিসংঘ মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবনে সংঘটিত ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত বুদ্ধ পূর্ণিমাকে ‘ভেসাক ডে’ বা 'বৈশাখী দিবস' হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই থেকে প্রতিবছর যথাযথ মর্যাদা সহকারে উদযাপন ও পালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ। বৌদ্ধপ্রধান রাষ্ট্রসমূহে বিপুল সমারোহে এবং জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো সরকারি ভাবে এ দিবসটি ভেসাক ডে হিসাবে পালন করছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা পৃথক শুভেচ্ছা বাণী প্রদান করেছেন। কিছুকিছু জতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে থাকে।
জগতে মহাপুরুষের আবির্ভাব অত্যন্ত দুর্লভ। কিন্তু তার চেয়ে বেশি বিরলতম ঘটনা হলো একই দিনে জন্ম, বোধিজ্ঞান লাভ এবং মহাপরিনির্বাণ তথা দেহত্যাগ। বুদ্ধের জীবনে এই বিরলতম ঘটনাত্রয় সংঘটিত হয়েছে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে। এই শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ নামের যে মহাসূর্য উদিত হয়েছিলেন; এই দিনেই জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়ে জগতকে মুক্ত জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে পুণরায় শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে অস্তমিত হলেন। তাইতো দিবসটি বৌদ্ধদের নিকট গভীর তাৎপর্যবহ।
বৌদ্ধ ধর্ম পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগুলোর অন্যতম। ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে, জগৎ অনাচার-পাপাচারে নিমজ্জিত হলে জগতের কল্যাণে এবং মানুষকে জীবনের সঠিক ও আলোর পথে পরিচালিত করতে বুদ্ধ ধরায় এসেছিলেন। তিনি মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন। বুদ্ধের আবিস্কৃত ধর্মে মূলমন্ত্র হচ্ছে জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। গৌতম বুদ্ধ বিশ্বের মানুষের দুঃখ-বেদনাকে নিজের দুঃখ বলে হৃদয়ে উপলব্ধি করেন। মানবজীবনের দুঃখ তার দৃষ্টিগোচর হলে তিনি সম্পদ, ঐশ্বর্য তথা সংসার জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু- এ চারটির কারণ উদ্ঘাটন এবং মুক্তির চিন্তায় নিমগ্ন হন। এক সময় রাজপ্রাসাদের বিত্তবৈভব, সুখ ও স্বজনের মায়া ত্যাগ করে সিদ্ধিলাভের পন্থা অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন অজানার পথে। দীর্ঘ ছয় বছর সাধনার পর গৌতম বুদ্ধ বোধিজ্ঞান লাভ করেন। মাহমতি বুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক, সমাজসংস্কারক, মানবতার ধ্বজাধারী।
বোধিজ্ঞান লাভ পরবর্তী শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে বসে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের উদ্দেশ্যে প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন তথা বুদ্ধের বোধিজ্ঞান লাভের মুলসূত্র মধ্যমপন্থার মাহাত্ম বর্ণনা, চারি আর্যসত্যের বিস্তর বর্ণনা, আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্বলিত সদ্ধর্ম দেশনা করেন। বুদ্ধের ৪৫ বছরের ধর্ম অভিযান শুরু করেন এই পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে নিয়ে। মধ্যমপন্থা অবলম্বন, চারি আর্য সত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ একটি ক্রুটিমুক্ত সহজ সরল পুণ্যময় উত্তম জীবনবিধান যা পৃথিবীর সকল মানুষ সহজেই অনুধাবন, অনুধ্যান ও অনুশীলন করতে পারে। তাইতো তিনি আজ বিশ্বজয়ী।
বুদ্ধের বিশ্বজয়ের কাহিনী জানতে হলে, নিজেকে বিশ্বজনীন করতে হবে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্মগ্রন্থ "ত্রিপিটক" অনুশীলন করতে হবে। ত্রিপিটকের মুল ভাষা পালি হলেও এখন বাংলা, ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। আসুন আমরা ত্রিপিটক অনুশীলনের মাধ্যমে প্রথমে নিজেকে জয় করি, বুদ্ধবাণী প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্মের শ্রীবৃদ্ধিতে এবং বিশ্বশান্তি কামনায় অবদান রাখি। শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক বিশ্বময়, অশান্ত বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
লেখক পরিচিতি :
লায়ন উজ্জল কান্তি বড়ুয়া,
কলাম লেখক ও সংগঠক
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan